চরগুলোতে শীতের পুরো মৌসুম জেলেরা ট্রলার কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অবস্থান করে। এসব চরে নজর পড়েছে ভূমিদস্যু এবং জোতদারদের। এছাড়া চরগেুলোকে আগেভাগেই কাগজপত্রে বন্দোবস্ত নেয়ার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে এক শ্রেণির দখলবাজচক্র। যে কারণে সাগরে নৌ-চলাচল অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে সাগরে এভাবে চর পড়তে থাকে। প্রথমত এসব ডুবোচর ছিল। ভাঁটার সময় চরগুলোতে হাটুজল থাকত, যা এখন জোয়ারের সময়ও জেগে থাকছে। তুফাইন্যার বনাঞ্চল ঘেরা চরের দুই কিলোমিটার দক্ষিণে অন্তত ছোট-বড় সাতটি চর জেগে উঠেছে।
এসব চরে জেলেরা শীত মৌসুমে নৌকা কিংবা ট্রলার বেধে অবস্থান করে। এ চরের কারণে এখন নৌযান চলাচল করতে হয় অন্তত ৩০ কিলোমিটার গভীর সাগরের মধ্য দিয়ে। এভাবে চর হেয়ার, চর কাশেম, সোনার চর, কাউয়ার চর, গঙ্গামতির চর, কুয়াকাটাসহ রামনাবাদ মোহনা, আন্ধারমানিক মোহনা থেকে সাগর অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠেছে। এসব চর জেগে ওঠায় বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন মাছ ধরার ট্রলার চলাচল পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।
সমুদ্রপথ নৌ চলাচলও চরম ঝূঁকির কবলে পড়েছে। গভীর সমুদ্রের কোথাও কোথাও নির্বিঘ্নে নৌযান চলাচল করতে পারে না। বিশেষ করে ভাটার সময় স্পিডবোটও নির্বিঘ্নে চালানো যায় না।
জেলে সমিতির নেতা শেখ নিজামউদ্দিন জানান, ‘আমরা খুটা জেলে, সাগরের অগভীর এলাকায় মাছ ধরি। এখন এগুলোতে চর জেগেছে। সিডরের পরে এভাবে সাগরের মাঝে ছোট-বড় অসংখ্য চর জাগতে শুরু হয়।’
চরের কারণে ২০০৯ সালে কুয়াকাটা এবং তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা জিও কাইনেটিক্স সুষ্ঠুভাবে তাদের কাজ পরিচালিত করতে পারে নি। এমনকি পূর্ব পরিকল্পিত ম্যাপ থেকে একটি সাইসমিক লাইন তাদের বাদ দিতে হয়েছে। যা পরবর্তীতে স্থানান্তর করে নতুন সাইসমিক লাইনে সম্পন্ন করতে হয়।
জিও কাইনেটিক্সের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, কূল থেকে প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। যে কারণে তাদের স্পিডবোট চলাচলে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
তিনি বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম থেকে শুরু করে ১৫-২০ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র পর্যন্ত পূর্ব দিকের প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। জোয়ারের সময় চরগুলো হাঁটু কিংবা কোমর সমান পানিতে ডুবে থাকে। কিন্তু ভাটায় পুরো ল্যান্ড এলাকা জেগে ওঠে। জেলেরা পায়ে হেঁটে চলাচল করে।
কুয়াকাটার উপকূলীয় জেলে সমিতির সভাপতি জনি আলমগীর জানান, কুয়াকাটা সৈকত থেকে ১০ কিলোমিটার সাগর গভীরে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। যেখানে জোয়ারে ৭-৮ ফুট পানি থাকলেও ভাটার সময় মাত্র ৩-৪ ফুট থাকে। ট্রলার চালাতে হয় ধীরে ধীরে।
তিনি আরও জানান, অবস্থা এমন হয়েছে যে সাগর থেকে মাছ ধরে আন্ধার মানিক মোহনায় ঢুকতে গেলে এখন সমস্যা হয়। সাগর থেকে প্রায় পশ্চিম দিকে ৪-৫ কিলোমিটার ঘুরে ফাতড়ার বনের কিনার থেকে থেকে বোট চালিয়ে মহীপুর আসতে হয়।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডিন অধ্যাপক আ.ক.ম মোস্তফা জামান বলেন, জেলেদের ধারণা ঠিক। কারণ সিডরে ঝড়ের মুভমেন্টে রাতের স্রোতের সৃষ্টি হয়ে পলি জমেছে। ওই পলির সঙ্গে ভেসে আসা পলি জমে ক্রমশ চর পড়ছে, যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কুয়াকাটার ৩০-৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ক্রমশ চর পড়ছে তা দেখা যায়। গঙ্গা অববাহিকার কারণে ক্রমাগতভাবে দক্ষিণে চরের বিস্তৃতি ঘটতে থাকবে বলেও এ বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন।
মহীপুর আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জানান, ভাটার সময় সাগর থেকে মহীপুরে আসতেই সমস্যা হয়। এরপর মাছ ধরে কিনারে ফিরতে অনেক সময় লাগে।
তিনি আরও জানান, আগে মহীপুর আলীপুর থেকে বোট ছেড়ে ৪-৫ ঘণ্টা সাগরে চালালে ৫ বাম (১৫ হাত গভীর) পানিতে জাল ধরা যেত। আর এখন ১০-১২ ঘণ্টা বোট চালানোর পরেও ওই পরিমাণ গভীর সাগরে পৌঁছানো যায় না। সাগরে যেভাবে চর জাগতে শুরু করেছে তাতে ভবিষ্যতে ইলিশ আহরণের ক্ষেত্রও পাল্টে যাওয়ার শঙ্কা জেলেদের।
আরও পড়ুন: ইলিশ আহরণে শীর্ষে বাংলাদেশ